জীবন্ত কিংবদন্তি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
শাহ মতিন টিপুতিনি একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক।তার জীবনের উল্লেখযোগ্য কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। যা চল্লিশ বছরেরও বেশি ধরে ‘আলোকিত মানুষ’ তৈরি করে যাচ্ছে। তিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ।
২০০৪ সালে তিনি রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন। অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য ২০০৫ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। ২০১২ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সমালোচক এবং সুবক্তা এই মহৎপ্রাণ মানুষটির ৮২তম জন্মদিন আজ।
সর্বজনে বিস্তৃত রয়েছে, তিনি আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর। কেউ বলেন একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব । আসলে নিজ কর্মগুণে তিনি হয়ে উঠেছেন জীবন্ত কিংবদন্তি । ১৯৩৯ সালের ২৫ জুলাই পার্ক সার্কাস, কলকাতায় তার জন্ম ।
আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ খুব অল্প বয়সে মাকে হারান। তিনি ছিলেন ভাইবোনদের মধ্যে তৃতীয়। আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদের জীবনে তার পিতার প্রভাব সুস্পষ্ট। অধ্যাপনা করেছেন তিনি তিরিশ বছর-১৯৬২ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত।
কেন তিনি শিক্ষক হয়েছিলেন- এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন, 'শিক্ষক হিসাবে আব্বা ছিলেন খ্যাতিমান। ১৯৫০ সালে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, আব্বা তখন পাবনা এডোয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষ। কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তার কথা উঠলে এমন সশ্রদ্ধ উদ্বেলতায় উপচে পড়ত যে মনে হত কোনো মানুষ নয়, কোনো দেবতা নিয়ে তারা কথা বলছে। একজন ভালো শিক্ষক ছাত্রদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ভালোবাসার যে কী দুর্লভ বেদিতে অধিষ্ঠিত থাকেন আব্বাকে দেখে তা টের পেতাম। একজন মানুষের এর চেয়ে বড় আর কী চাওয়ার থাকতে পারে। তখন থেকেই আমি ঠিক করেছিলাম এই পৃথিবীতে যদি কিছু হতেই হয় তবে তা হবে শিক্ষক হওয়া, আব্বার মতোন শিক্ষক।’
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তার একটি অনন্য সৃষ্টি। এর জন্ম ১৯৭৮ সালে। প্রথমদিকে তার তত্ত্বাবধানে মাত্র পঁচিশ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী বিশ্বের মহান সাহিত্যকর্মগুলো পাঠ ও তার ওপর আলোচনা করা শুরু করে। ধীরে ধীরে এই পাঠচক্রে স্কুল-কলেজ ও সাধারণ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই পাঠচক্রগুলোতে বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বইগুলোর পঠন এবং সেগুলোর ওপর প্রাণবন্ত আলোচনা করা হয়। বর্তমানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আলো প্রায় সারা দেশজুড়ে বিস্তৃত।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র'র একটি চমক হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। এই কার্যক্রমে বই-ভর্তি একটি বাস পাঠকের দুয়ারে গিয়ে হাজির হয়। ১৯৯৮ সালে এই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি ঢাকায় শুরু হলেও আজ তা বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায় বিস্তৃত হয়েছে।
শিক্ষকতা জীবনও খুবই বর্ণাঢ্য তার ।১৯৬১ সালে প্রথম শিক্ষকতায় যোগদান করেন মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে। তখন বয়স বাইশ। ওই সময়ে মুন্সীগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তার বাবা আযীমউদ্দীন আহমদ। শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার হিসাবে যিনি সেকালে দেশের সুধীমহলে সুপরিচিত । ছেলে একই কলেজে যোগ দিলে তার জন্য প্রশাসনিক অস্বস্তির কারণ হবে মনে করে তিনি কলেজের গভর্নিং বোর্ডের সভায় আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদকে অন্তর্ভূক্তি করার ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল ভাল থাকায় কলেজের গভর্নিং বডির সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে কলেজের খন্ডকালীন প্রভাষক হিসাবে তাকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। গভর্নিং বডির সচিব হিসাবে তার বাবাকেই তার নিয়োগপত্র পাঠাতে হয়েছিল। সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তটি জমে উঠেছিল কলেজে তার যোগদানের প্রথম দিনটিতে।
সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি এভাবে, ‘প্রথম ক্লাশে ছাত্রদের সঙ্গে নতুন শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব অধ্যক্ষই পালন করতেন এটাই ছিল নিয়ম। আমার ব্যাপারেও আব্বাকেও তাই করতে হলো। রুটিন মাফিক আব্বার পেছনে পেছনে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির একটি শাখায় গিয়ে হাজির হলাম। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তার সংক্ষিপ্ত ইংরেজি ভাষণে আব্বা আমার একটা ছোটখাট পরিচয় তুলে ধরে সব শেষে বললেন, যেহেতু ওর শরীরে শিক্ষকের রক্ত আছে আমার মনে হয় ও ভাল শিক্ষকই হবে। আমার ধারণা ছিল, আমার নিয়োগের দ্বন্দ্বে পরাজয়ের ফলে উনি ভেতরে ভেতরে কিছুটা তেতে আছেন। হয়ত তার সেদিনের বক্তব্যে সেই ক্রোধের কিছু প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু ঘটনা হলো ঠিক উল্টো। বক্তৃতার সময় আব্বার গলা কিছুটা ধরেই এল। মনে হল তার উত্তরসূরির আসনে নিজ হাতে আমাকে বসিয়ে যেতে পেরে তিনি যেন ভেতরে ভেতরে গর্বিত এবং পরিতৃপ্ত।'
এরপর সিলেট মহিলা কলেজে যোগ দেন । সেই সময় মহিলা কলেজে ঢোকা তরুণ অধ্যাপকের জন্য সহজ ছিল না। কারণ তখন সিলেটের সমাজ খুবই রক্ষণশীল । এখানে তিনি বেশিদিন ছিলেন না।
এরপর রাজশাহী কলেজে। রাজশাহী কলেজের অত্যন্ত উঁচুমানের লাইব্রেরি তাকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল । রাজশাহী কলেজে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি যোগ দেন ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে। একই সময় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগেও তিনি খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে বাংলা পড়িয়েছেন। ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
এর পর ঢাকা কলেজে। তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শত্তকত ওসমান।
ঢাকা কলেজের শিক্ষকতা জীবন তিনি খুব উপভোগ করতেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু ঢাকা কলেজ ছেড়ে তিনি যাননি৷
এই মানুষ গড়ার কারিগরের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ঢাকা/টিপু
0 coment�rios: